প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও ত্রিশলাখ শহীদ ও দু’লাখ নি’র্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
আগামীকাল ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষ্যে আজ দেয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, “জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি-প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও ত্রিশলাখ শহীদ ও দু’লাখ নি’র্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখবো।
জাতির পিতা যে অসা’ম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সকল ষ’ড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযু’দ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কার্যকরি ভূমিকা রাখবো, ইনশাআল্লাহ।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক ক্ষণজ’ন্মা মহাপুরু’ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কা’রাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
এই মহান নেতার অনুপস্থিতিতে আমাদের মুক্তিযু’দ্ধে চূড়ান্ত জয়ের উল্লাস-উদ্দীপনায় অপূর্ণতা ছিল যেমন স্পষ্ট, তেমনই যু’দ্ধবি’ধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে তাঁর নেতৃত্বগ্রহণ সার্বজনীন উপলব্ধিতেও ছিল অতি প্রতীক্ষিত। তাই, ১০ জানুয়ারি বাংলার মানুষ তাদের প্রা’ণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে অনুভব করেছিল পরিপূর্ণ বিজয়ের স্বাদ।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য দীর্ঘ ২৪ বছর সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম সকল ক্ষেত্রেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জে’ল-জু’লুম সহ্য করেছেন, সবসময় দূরদর্শী সি’দ্ধান্ত দিয়েছেন এবং ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি সা’মরিক জান্তা জনগণের এ রায়কে উপেক্ষা করে, শুরু করে প্রহসন। বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে গু’লি করে হ’ত্যা করে। চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের এক জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন ‘…প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।
…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। পঁচিশে মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানি হা’নাদারবাহিনী বাঙালি নিধ’ন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী জাতির পিতাকে গ্রে’ফতার করে পাকিস্তানের নির্জন কা’রাগারে প্রেরণ করে এবং তাঁর ও’পর অবর্ণনীয় নি’র্যাতন চালাতে থাকে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন,
‘প্রহসনের বিচারে ফাঁ’সির আ’সামি হিসেবে মৃ’ত্যুর প্রহর গুণতে গুণতেও তিনি বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রা’ণশ’ক্তি। তাঁর অবিচল নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মরণপণ যু’দ্ধ করে বিজয় ছি’নিয়ে আনে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বা’ধ্য হয়। একই দিন সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে তিনি লন্ডনে অবতরণ করেন।
সেখানে কমনওয়েলথ মহাস’চিবের আহ্বানে বাংলাদেশের সদস্যপদ গ্রহণে তাৎক্ষণিক সম্মতি জানান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স’ঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেন। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লীতে যাত্রা বিরতি দিয়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বাংলার মাটিতে পদার্পন করেন।
ঐদিন রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে এক ভাষণে তিনি পাকিস্ত’নি সা’মরিক জান্তার নি’র্মম নি’র্যাতনের বর্ণনা দেন। সেই স’ঙ্গে মহান মুক্তিযু’দ্ধের সময় গণহ’ত্যা সংঘটনের দায়ে পাকিস্তানি সে’নাবা’হিনীকে বিচারের মুখোমুখী করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে যু’দ্ধবি’ধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশ’ক্তি নিয়োগ করেন। তাঁর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। তিনি ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।
তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বন্ধুদেশ দ্রু’ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে অতি অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এবং একটি যু’দ্ধবি’ধ্বস্ত দেশ থেকে মাত্র সাড়ে তিনবছরেই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পচাঁত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বি’রোধী ও যু’দ্ধাপরাধীচ’ক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে নি’র্মমভাবে হ’ত্যা করে এদেশে হ’ত্যা, ক্যু ও ষ’ড়যন্ত্রের রাজনীতি চালু করে। তারা ‘৭৫ এর ২৬ সেপ্টেম্বর দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হ’ত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
মোস্তাক-জিয়াচ’ক্র খু’নিদের বাংলাদেশ দূ’তাবাসগুলোতে কূটনৈতিকের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে, রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত করে। মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হ’ত্যা করে। মুক্তিযু’দ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করে। সংবিধানকে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে। বিএনপি-জামাত স’রকার এ ধারা অব্যাহত রাখে।
২১ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স’রকার গঠন করে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, একই বছর ১২ নভেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল আইন, ১৯৯৬’ সং’সদে পাশ করে। এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুহ’ত্যার বিচারের সকল বা’ধা দূর হয়।
তিনি বলেন, “আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ‘দিনবদলের সনদ’ ঘোষণা দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করি এবং পরপর তিনদফা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হই। আমরা জাতির পিতার হ’ত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছি। ‘আন্তর্জাতিক অ’পরাধ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যু’দ্ধপরাধীদের বিচার করেছি।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধ’নীর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছি, ফলে অ’বৈধভাবে ক্ষ’মতা দ’খলের পথ বন্ধ হয়েছে”, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত বারো বছরে আমরা উন্নয়নের সকল সূচকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধ’ন করেছি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদন্ডে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছি। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছি। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ মা’র্কিন ডলারে উন্নীত করেছি।
এখন আমাদের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছর। ৯৯ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিচ্ছি। পদ্মাসেতুর সকল স্প্যান বসানোর ফলে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীর দু’প্রান্ত এখন সংযুক্ত হয়েছে। রাজধানীতে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ কাজ দ্রু’ত এগিয়ে যাচ্ছে। সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আজ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছি।’
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ত’থ্যপ্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশিতে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করায় সুনীল-অর্থনীতির দ্বার এখন উন্মুক্ত। প্রথম ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’র সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রূপকল্প-২০২১ অর্জন প্রায় শেষ।
মুজিববর্ষে অ’ঙ্গীকার করা হয়েছে কেউ গৃহহীন থাকবে না। শহরের সকল সুযোগ-সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে দেয়া হবে। জ’ঙ্গীবাদ, স’ন্ত্রাসবাদ ও মা’দক নির্মূ’লে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কাজ করা হচ্ছে।
২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট’ অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ প্রণয়নসহ ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার জ’ন্মশতবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে আমরা ২০২০-২০২১ সময়কে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছি। ২৬ মার্চ ২০২১ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবো। কিন্তু, এরই মধ্যে বৈরী কোভিড-১৯ ক’রোনাভা’ইরাসে সারাবিশ্বে ম’হামা’রী আকারে ছড়িয়েছে। ’
“আমরা পূর্বঘোষিত পরিকল্পনা সীমিত পরিসরে ডিজিটাল-মাধ্যমে চালু রেখে এ ম’হামা’রী থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে জীবনযু’দ্ধে নেমেছি। আমি ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছি, ক্রান্তিকাল উত্তরণে ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান নিয়োগ করেছি।
দরিদ্র-অ’সহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ২১টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছি। ক’রোনা ম’হামা’রী পরিস্থিতিতেও আমরা ৫.২৪ শতাংশ জি’ডিপি প্রবৃ’দ্ধি অর্জন করেছি” বলেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার মহা’নায়ক, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষ্যে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।